দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়া ভাইখ্যাত নায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান। তিনি অবশ্য নায়ক ফারুক নামেই সবার কাছে চির পরিচিত। এ নামটি তাকে দেওয়া হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোশাকি নাম হিসেবে। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর এবং ফারুক নামে নিজের একজন বন্ধু মিলে তাকে দিয়েছিলেন এ নাম। সিনেমায় আসার আগে তিনি পরিচিত ছিল দুলু নামে। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রজীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লায় নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। সাধারণ এক যুবক দুলু এভাবেই হয়ে উঠেন বাংলা ভাষার সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেতা ফারুক।
চলচ্চিত্রে আসার কারণ হিসেবে এই কিংবদন্তি অভিনেতা বলেন, ছাত্রলীগ করার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমার বিরুদ্ধে ৩৭টি হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে। এসব মামলা থেকে বাঁচতে বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে চলচ্চিত্রে আসি।
নায়ক ফারুকের প্রাথমিক জীবন
আকবর হোসেন পাঠান দুলু ওরফে নায়ক ফারুক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। ফারুকের জন্ম হয় ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওরে। তিনি মানিকগঞ্জের ঘিওরে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকাতে। তিনি পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শৈশবে। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিল পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ফারুক ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট ও ডানপিটে। ফারুক ছোট বেলাতে ছিলেন খুবই চঞ্চল স্বভাবের। তিনি সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন মাঠে খেলার জন্য।
নায়ক ফারুকের সিনেমার ক্যারিয়ার
নায়ক ফারুক জলছবি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সিনেমাজগতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম ছবিটি পরিচালনা করেন এইচ আকবর ১৯৭১ সালে। প্রথম ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে বলে খ্যাত কবরী। পরে কবরী ও ফারুক জুটি এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। তার প্রথম ছবির পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উপহার দিয়েছেন একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা।
নায়ক ফারুক কাজ করেছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি পরিচালক খান আতাউর রহমান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, স্বপন ঘোষ, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেনসহ আরও গুণী পরিচালকদের সঙ্গে। এ গুণী পরিচালকদের হাত ধরেই তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক কালজয়ী সিনেমা। যা বাংলার সিনেমাপ্রেমীদের মাঝে হিরো ফারুককে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। তিনি প্রায় ১০০ সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে বেশিরভাগ সিনেমাই দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছিল।
রাজনীতিতে নায়ক ফারুক
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন ফারুক। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অংশগ্রহণে কোনো রক্তচক্ষু তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধজাহাজ চালানোর স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলায়। নিজের আদর্শ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সমানভাবে সক্রিয় তিনি। ১১তম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতিও ছিলেন তিনি।
সিনেমার অভিভাবক ফারুক
কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন নিয়ে গঠিত চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক তিনি। চলচ্চিত্রে এক সময় যখন ধস নামে তখন সবার আহ্বানে চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে তিনি পরিবেশক সমিতির নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং চলচ্চিত্রের অন্য সংগঠনগুলোকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে নানা পদক্ষেপ নিয়ে এই ধস দূর করেন।
তখন দেশে থাকা ৭শ সিনেমা হলকে প্রায় ১৪শতে উন্নীত করেন। এরপর সফলভাবে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স প্রবর্তনে ভূমিকা রাখেন। ফারুক হলেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এ সমিতি প্রতিষ্ঠা করলেও নিজে এর সভাপতি না হয়ে নায়করাজ রাজ্জাককে তিনি সভাপতি হতে প্রস্তাব রাখেন।
নায়ক ফারুকের পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়া ভাইখ্যাত নায়ক ফারুক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৭৫ সালে। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত বিখ্যাত লাঠিয়াল সিনেমায় অভিনয় করার কারণে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
লাঠিয়াল সিনেমাটি ছিল মিয়া ভাইয়ের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমার একটি। চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার আজীবন সম্মাননা প্রদান করে থাকে। ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও বাচসাসসহ অগণিত গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননায় ভূষিত হন মিয়া ভাই ফারুক।
ফারুকের সুপারহিট সিনেমা
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। এ ছবিতে ফারুকের চরিত্র ছিল বেশ গভীর। এতে তাকে জাতীয় পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে চূড়ান্ত করা হলেও তৎকালীন বঙ্গবন্ধুপরবর্তী সরকার জোর করে তাকে পার্শ্বঅভিনেতার পুরস্কার দেয়।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া আরেকটি ছবি তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছবিটি হলো ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমির গল্প। মেলোড্রামাটিক ছবি। এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন ফারুক। এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদেই আমাদের চলচ্চিত্রে গ্রামীণ যুবকের চরিত্রে ফারুক স্থায়ী আসন গড়ে তোলেন।
১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ ছবিটির বাণিজ্যিক সাফল্য ফারুককে নায়ক হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ মুক্তি পায়। শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত এ ছবিটির ‘কদম সারেং’ চরিত্রে জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য ক্ল্যাসিক অভিনেতা হিসেবে গণ্য হন।
সে বছরই আমজাদ হোসেনের ‘ গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে মিলন চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন ফারুক। বিশেষ করে মৃত্যুর দৃশ্যে তার অভিনয় দর্শককে কাঁদায়।
১৯৭৯ সালে ফারুক হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক। সে বছর তার অভিনীত ৩০টির বেশি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। বিশেষ করে গ্রামীণ তরুণের আইকন হয়ে যান তিনি। আজিজুর রহমান নির্মিত ‘জনতা এক্সপ্রেস’ ছবিতে নিজের শিশুসন্তানকে বলি দিয়ে ট্রেনযাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছেন এমন এক ট্রেনচালকের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেন ফারুক।
‘মিয়া ভাই’ ছবিটি সাফল্য পাওয়ার পর দর্শক মহলে তার ‘মিয়া ভা ‘ নামটি জনপ্রিয়তা পায়। নব্বই দশকের শেষে কয়েকটি চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখা যায় ফারুককে।
ফারুকের সংক্ষিপ্ত জীবনী
পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু, ডাকনাম দুলু, মিয়া ভাই। স্ত্রীর নাম ফারজানা পাঠান। ছেলের নাম রওশন হোসেন, মেয়ে ফারিহা তাবাসসুম পাঠান। বাবার নাম আজগার হোসেন পাঠান। জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। প্রথম সিনেমা জলছবি। অভিনীত চলচ্চিত্র ১০০+। পেশায় চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ। রাজনীতির দল আওয়ামী লীগ। জাতীয়তা বাংলাদেশি। বড় অর্জন : একজন বীর মুক্তিযুদ্ধা। সম্মাননা : বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
শহীদ মিনারে চিত্রনায়ক ফারুককে শ্রদ্ধা
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন খান দুলু ওরফে ফারুককে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
মঙ্গলবার (১৬ মে) বেলা ১২টার দিকে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে কমডোর এম এম নাঈম রহমান শ্রদ্ধা জানান।
পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানো হয়। তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নার চাঁপা ও নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
এরপর ধাপে ধাপে সংস্কৃতি মন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় কবিতা পরিষদ, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ফারুকের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফারুকের মরদেহ দুপুর ২টায় এফডিসিতে নেওয়া হয়। সবশেষে তাকে গুলশান আজাদ মসজিদে ৩টায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আসরের নামাজের পর তার প্রথম জানাজা হয়। এরপর গাজীপুরের কালীগঞ্জে আরেক দফা জানাজা শেষে দক্ষিণ সোম টিওরি পাকা জামে মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন আকবর হোসেন পাঠান ফারুক।
সোমবার সকাল ৮টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ ফ্লাইটে মঙ্গলবার (১৬ মে) সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তার মরদেহ দেশে পৌঁছায়।
এফডিসিতে ফারুকের দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন
রাজধানীর তেঁজগাওতে অবস্থিত এফডিসিতে চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় বিভিন্ন তারকাদের সাথে এফডিসি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা উপস্থিত ছিলেন। ফারুকের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সিংগাপুরে।
COMMENTS